১৬ বছর পর মুক্ত ১৭৮ বিডিআর জওয়ান

স্টাফ রিপোর্টার ঢাকা ও গাজীপুর : পিলখানায় বিডিআর হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রায় ১৬ বছর ধরে কারাগারে আটক ১৬৮ জন সাবেক বিডিআর জওয়ান অবশেষে জামিনে মুক্তি পেলেন। তাদের মুক্তির দিন থাকায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই কেরাণীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে ভিড় করেন নানা বয়সী স্বজনরা। অনেকের হাতে দেখা যায় ফুল। গাজীপুরের কাশিপুর কারাগারের বাইরেও স্বজনদের ভিড় দেখা যায়। অনেকে সেখানে মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন প্রিয়জনের জন্য। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এই সদস্যরা হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে কারাগারে আটকে ছিলেন প্রায় ১৬ বছর ধরে। গতকাল তাঁরা ফিরলেন স্বজনদের সান্নিধ্যে, মুক্ত পরিবেশে।

ঢাকার বিশেষ ট্রাইবুনাল-২ এর বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়া গত রোববার বিস্ফোরক আইনের মামলায় তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর মঙ্গলবার জামিনপ্রাপ্ত ১৭৮ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়।

জানতে চাইলে মোট ১৭৮ জন মুক্তি পাচ্ছেন জানিয়ে কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স-ঢাকা বিভাগ) জাহাঙ্গীর কবির গতকাল রাতে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৪৩ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৭ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে ৯৫ জন এবং কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৩ জন সাবেক বিডিআর জওয়ান সদস্য মুক্তি পান। এর আগে বুধবার তাদের জামিননামা দাখিল করা হয়। এরপর তাদের জামিন সংক্রান্ত নথিপত্র কারাগারে গেলে শুরু হয় মুক্তির প্রস্তুতি।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।

বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকা-ের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে যায় ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।

বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে কেবল হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়। অন্যদিকে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।

২০১৭ সালের ২৭ নবেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাই কোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।

হাই কোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন।

অন্যদিকে হাই কোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।

ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনা পুনঃতদন্তের দাবি জোরালো হয়। এরপর ওই হত্যাকা- পুনঃতদন্তে গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করে দেয় সরকার। কমিশনকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।

মুক্তিপ্রাপ্ত বিডিআর জওয়ানদের তিন দাবি

কেরানীগঞ্জ (ঢাকা কেন্দ্রীয়) কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ৪৩ জন বিডিআর জওয়ানর মধ্যে কেউ বৃদ্ধ, কেউ অসুস্থ আবার কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত। মুক্তির পর তারা কেবলই তাকিয়ে ছিলেন। একেবারই যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন তারা। এরপরও দু‘একজন দাবি দাওয়া নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বাইরে আগে থেকেই মুক্তি পাওয়া অন্যান্য বিডিআর জওয়ানরা। মুক্তি পাওয়া বিডিআর জওয়ানরা তিন দফা দাবি তুলে ধরেন।

তারা বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় মামলায় আরও যারা কারাগারে রয়েছেন তাদের দ্রুত মুক্তি; যারা চাকরি হারিয়েছেন, নানান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাদের ক্ষতিপূরণনসহ চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া এবং সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

হাবিলদার এমদাদুল হক সকলের উদ্দেশ্য বলেন, ‘একজন জওয়ানও বন্দি থাকা অবস্থায় আমরা আন্দোলন থেকে পিছপা হব না। সবাইকে মুক্ত করেই ছাড়বো। এজন্য মুক্তিপ্রাপ্ত সকলকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।’

ন্যায়বিচারের নতুন আহ্বান

গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বিডিআর জওয়ানদের পরিবারের জন্য মুক্তির ক্ষনটি ছিল আনন্দের। এসময় তারা তুলে ধরেছেন ন্যায়বিচারের দাবি। গতকাল সকাল থেকে কারা ফটকের সামনে ভিড় জমায় মুক্তি পাওয়া সদস্যদের স্বজনরা। কেউ ফুল, কেউ মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মুক্তির পর কারা ফটকে তাদের প্রিয়জনকে দেখে কেউ আনন্দে, কেউবা দীর্ঘদিনের কষ্টে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। নেত্রকোনার আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। এত বছরেও সেই ক্ষত ভুলতে পারিনি।”

ময়মনসিংহ ৪৫ ব্যাটালিয়নের সিপাহী মামুনের অভিযোগ, “বিনা বিচারে আমাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। আমার মেয়ের পুরো শৈশব আমার অনুপস্থিতিতে কেটেছে।” ঢাকা সদর ব্যাটেলিয়নের সিপাহী আবু হাসান জানান, “বিদ্রোহের সময় চাকরির বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। অথচ আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।”

জামাল উদ্দিন খানের মেয়ে জুয়েনা বলেন, “বাবাকে দেখার জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করেছি। তার আদর না পেলেও আজ তাকে ফিরে পেয়েছি, এই সুখ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।”

সাবেক বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবার ন্যায়বিচারের জন্য সরকারের কাছে নতুন করে ছয়টি দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে,নির্দোষদের মুক্তি, পুনর্বহাল, ক্ষতিপূরণ, তদন্ত কমিশনের স্বাধীনতা, এবং পিলখানা হত্যাকা-ে নিহতদের স্মরণে জাতীয় দিবস ঘোষণা।

বিডিআর সদস্যদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ বলেন, “নিরপরাধদের মুক্তি ও প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে তদন্ত প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে হবে।”

পিলখানা হত্যাকা-ে জড়িতদের শাস্তি ও নিরপরাধদের মুক্তির জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন জরুরি। সরকার যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, তবে এ ঘটনার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা।

গাজীপুরের মাটিতে এ ঘটনাটি শুধু একটি খবর নয়, এটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সংগ্রামী জীবনযুদ্ধ চালানো এসব সদস্য আজ দেশবাসীর কাছে সত্য ও ন্যায়ের দাবিতে এক অনুপ্রেরণা।

কারামুক্ত হয়েই স্বৈরাচার পতনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুপুর ১টার দিকে জামিনপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্যরা একে একে বের হতে থাকেন। ধাপে ধাপে কারাগার থেকে বের হয়েই মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান তারা। এ সময় তাদের দেখে স্বজনরা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। এক আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। স্ত্রী-সন্তান বা স্বজনদের জড়িয়ে ধরে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বিডিআর সদস্যরা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বজনরাও কাঁদতে থাকেন।

কারাগার থেকে বের হয়ে বিডিআর সদস্যরা বলেন, বিনা দোষে জীবন থেকে আমাদের ১৬টি বছর চলে গেছে। আমাদেরকে অন্যায়ভাবে ১৬টি বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। এখন মুক্ত আকাশে বের হয়ে আমাদের ভালো লাগছে।

কারামুক্ত হয়ে আল আমিন নামে এক বিডিআর সদস্য বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার থেকে নামাতে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। আমাদেরকে বিনা দোষে এত বছর ধরে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। আজ আমরা কারামুক্ত। তবে এখনো আমাদের যেসব ভাইয়েরা বিনা দোষে কারাগারে রয়েছেন তাদেরকে দ্রুত মুক্ত করার ব্যবস্থা করুক সরকার।(মাহবুবুল ইসলাম)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *